একজন বেঁচে ফেরা মানুষের চোখে অভ্যুত্থানের দিন

“আমি গুলিবিদ্ধ”—একজন সাধারণ নাগরিকের সাক্ষ্য

৪ আগস্ট ২০২৪, সকাল ১০টার দিকে অফিস হঠাৎ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অভ্যুত্থানের কারণে আশেপাশের অন্যান্য কারখানাগুলোও ছুটি দেয়। সেই প্রেক্ষিতে আমাদের কারখানাও ছুটি ঘোষণা করে। তবে শ্রমিকদের বলা হয় সামনের গেট দিয়ে না, পেছনের গেট দিয়ে বের হতে। তখন আমি লিবার্টি নিটওয়্যার লিমিটেড (কালিয়াকৈর)-এ চাকরি করছিলাম।

অফিস থেকে বেরিয়ে আমি সরাসরি বাসায় না গিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ি। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। তখন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, যাকে অনেকেই অবৈধ সরকারপ্রধান মনে করত। কোটা আন্দোলনের সময় দেখা গেছে, ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়—এটা সম্ভব হয়েছিল কারণ দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে প্রশাসনের সব স্তরে দলীয় লোক বসানো হয়েছিল। তাই পুলিশ নির্দ্বিধায় শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালায়।

ফেসবুক আর টেলিগ্রামের ‘বাঁশের কেল্লা’ গ্রুপে গুলির ভিডিও দেখে আমার ভেতরটা গরম হয়ে উঠল। তখন মনে হলো, ঘরে বসে থাকা চলে না। ভাবতে ভাবতেই আমি রাস্তায় নেমে যাই।

৪ আগস্ট সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত, আমি ছাত্রদের সমর্থনে মিছিলে ও আন্দোলনে অংশ নিই। বিকেল ৪টার দিকে, আসরের আজানের সময় আমি দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম।

তারপর ঘোষণা আসে—"এক দফা, হাসিনার পতন" আন্দোলন শুরু হচ্ছে, আর ৬ আগস্ট "ঢাকা টু লং মার্চ"-এর ডাক দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের দমন-পীড়ন আর ১৪৪ ধারা জারির কারণে ছাত্ররা এবং সাধারণ মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় ৫ আগস্ট থেকেই লং মার্চ শুরু করবে।

তাই ৫ আগস্ট সকালে আমি কোথাও বের হইনি, কারণ ঢাকা যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি শুধু অপেক্ষা করছিলাম—কখন শুনব হাসিনা পালিয়ে গেছেন বা পদত্যাগ করেছেন।

বিকেলে দুপুরের খাবার খেয়ে নামাজ পড়ার পর দেখি, ইন্টারনেট বেশ দ্রুত চলছে। তখন টেলিগ্রামে একটা ভিডিও পাই—হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। কিছুক্ষণ পর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর আসে—হাসিনা ভারত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং সেনাপ্রধান সব কিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছেন।

পরে জানা যায়, সেনাপ্রধান ওকারুজ্জামান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু কিছু কারণে তা দেরি হয়। পরে তিনি ভাষণ দেন। সেই ভাষণ শোনার পর আমি আবার রাস্তায় বের হই। আমার বাসা রফিক সড়ক রোডে, সেখান থেকে হেঁটে পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় যাই।

পল্লী বিদ্যুৎ প্রধান সড়কে দেখি অনেক লোক জড়ো হয়েছে। তখন শুনি—আনসার একাডেমিতে গুলির ঘটনা ঘটেছে, কেউ কেউ আহত হয়েছে। তখন আমি ৯৯৯-এ ফোন দেই। সময় ছিল ৪টা ৪৯ থেকে ৪টা ৫৬র মধ্যে। একজন ফোন ধরে, আমি তাকে বলি: “যখন সেনাপ্রধান বলেছেন, আর কোথাও গুলি চালানো হবে না, তাহলে আনসার একাডেমিতে গুলি কেন হচ্ছে?”

তিনি বলেন, “আমি এখনই আনসার একাডেমিকে জানিয়ে দিচ্ছি।” প্রায় ১০ মিনিট পর গুলির শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আসরের আজানের সময় হয়ে যায়। আমি সামনে কোনো মসজিদ খুঁজছিলাম, যেখানে নামাজ পড়তে পারি। আনসার একাডেমির কাছে একটা অফিস মসজিদ পাই। বাইরে ট্যাবে ওজু করে ভিতরে যেতে চাইলে, একজন নিরাপত্তাকর্মী আমাকে বাধা দেয়। তিনি বলেন, “এখন ভেতরে যেতে পারবেন না, দু’বার জামাত হয়ে গেছে।”

ঠিক তখনই কেউ একজন বলে উঠল—“আনসাররা শেখ মুজিবের মূর্তি ভাঙছে।” তখন ভাবলাম, যাই দেখি কী হচ্ছে।

আমি দেখলাম, কিছু আনসার ভারতীয়দের মত পোশাক পরে আছে। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল—তারা বাংলাদেশি না। আর বাংলাদেশের আনসাররাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে শেখ মুজিবের মূর্তি ভাঙছে। সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে তা দেখছিল। আমি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলাম।

এই সময়, বড় বোনের স্বামী ফোনে কথা বলতে চাচ্ছিলেন। আমি তাকে বললাম, “আমি আপনাকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফোন করব।” তখন মাগরিবের আজানের সময়। আমার তখনও অজু ছিল, কিন্তু আসরের নামাজ পড়া হয়নি।

আমি বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে রাস্তার মাঝখানে এসে পৌঁছাই। ঠিক তখনই আনসার বাহিনী আবার গুলি চালানো শুরু করে। কিছুক্ষণ আগে তারা গুলি থামিয়ে দিয়েছিল—কেউ পানি খাচ্ছিল, কেউ বসে ছিল, কেউ দাঁড়িয়ে ছিল; দেখে মনে হচ্ছিল যে আবার গুলি চালাতে পারে। এই দৃশ্য দেখে আমি মাঝরাস্তায় পৌঁছে গিয়েছিলাম।

বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, হঠাৎ করেই আবার জোরে গুলি শুরু হলো। আনসার একাডেমির ৩ নম্বর গেট থেকে গুলির শব্দ আসছিল। আমি রাস্তাটা পার হয়ে উত্তর দিকে গেলাম। তখন আমি একাডেমির ১ নম্বর গেটের পাশে ছিলাম। আমি একটি ভবনের পাশে বসেছিলাম। তখনও গুলি চলছিল। একটু উঁকি দিয়ে দেখি—আনসার সদস্যরা রাস্তা পার হয়ে অনেক দূর চলে এসেছে, একেবারে কাছে চলে এসেছে। তাদের মধ্যে পাঁচজন গেট নং ১-এর উত্তরের একটা বাগানে ঢুকেছে।

আমি সেই বাগানের একটা গাছের ছায়ায় বসে ছিলাম, আমার সঙ্গে আরও অনেকে ছিল। চারজন আনসার সদস্য একে অপরের পিঠ ঘেঁষে চারদিকে গুলি ছুড়ছিল। আরেকজন আনসার আমাদের দিকেই লাঠি চালাচ্ছিল। আমি সেই লাঠি চালানো আনসারের পেছনে দৌড়ে বাগান থেকে বের হতে চাইলাম। ঠিক তখনই চারজনের মধ্যে একজন আমার শরীরে গুলি করে। গুলিটা ছিল সীসার মতো ভারী। গুলিবিদ্ধ হয়ে আমি পুকুরের ধারে পড়ে যাই।

05 august 2024

কিছুক্ষণ পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে। তখন বুঝতে পারলাম, আমাকে গুলি করা হয়েছে। মনে হচ্ছিল আমি আর বাঁচব না। চোখ খুলতে পারছিলাম না, ডান হাত-পা অসাড় হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে একেবারে অচল একজন মানুষ মনে হচ্ছিল। তখন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে থাকি, আর কালেমা পড়তে থাকি।

সেই সময় আমার ছোট ছেলের কথা মনে পড়ে যায়—তখন সে মাত্র এক বছরের ছিল, ঠিকমতো কথা বলতেও পারত না। ভাবছিলাম, যদি আমি মারা যাই, সে বড় হয়ে কীভাবে চলবে? এই চিন্তায় চিৎকার করতে চাইলাম, কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না—শব্দগুলো ধীরে ধীরে বের হচ্ছিল।

এরপর পাশের একটি ভবনের এক নারী জানালেন, “ভাই, পাশে একটা সরু রাস্তা আছে, ওই দিকেই বের হয়ে আসেন।” আমি হামাগুড়ি দিয়ে সেই গলির ভেতর ঢুকি, দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়াই। তখন আমার গায়ে একটা পোলো শার্ট ছিল, সেটা খুলে ফেলি।

গলিতে ঢুকে দেখি, আমার অফিসের সহকর্মী হাসনাত ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি হাতের ইশারায় আর নিচু গলায় তাকে ডাকলাম। তিনি আরেকজনকে নিয়ে এলেন এবং আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে চলতে শুরু করলেন।

পথে এক ভাই আমাকে পানির বোতল থেকে পানি খাওয়ালেন। পরে তারা আমাকে এক ফার্মেসিতে নিয়ে গেলেন। আমি রাস্তায় শুয়ে পড়েছিলাম। ফার্মেসির এক ডাক্তার আমার শরীরে হেক্সিসল লাগিয়ে দেন। তখন কয়েকজন গুলিগুলো বের করার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু গুলি শরীরের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল, বের করা যাচ্ছিল না।

এরপর হাসনাত ভাই আমাকে মৌচাক হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে দেখি, অনেক মানুষ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আছে। রোগীদের স্বজনদের অপেক্ষার জায়গাটিও আহতদের দিয়ে ভরে গেছে। সেখানে তারা আমার ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করে দেয়।

এই সময়, হাসনাত ভাই আমার বড় বোনের স্বামীকে ফোন করে জানালেন যে আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছি। পরে জানতে পারি, তিনি খবর শুনেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।

কোনো উন্নত চিকিৎসা না থাকায়, সিদ্ধান্ত নিই কোনাবাড়ি হাসপাতালে যাব। আমার শরীরের বিভিন্ন অংশ আগুনের মতো জ্বলছিল, শক্ত হয়ে যাচ্ছিল, বুকেও ছিল তীব্র ব্যথা। আমি অটোরিকশার মাঝখানে বসে বাড়িতে ফোন করেছিলাম। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে বললাম, “আমাকে গুলি করা হয়েছে, আমি হয়তো বাঁচব না।” পরে জানতে পারি, তিনি ফোনের পর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।

কোনাবাড়ি হাসপাতালে পৌঁছে আমাকে জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। আমি তখন বসতে বা দাঁড়াতেও পারছিলাম না। ডাক্তাররা স্যালাইন দিয়ে কিছুটা আরাম দেন।

সেখানে আমি একা ছিলাম না—অনেকেই ছিল। আমার সামনেই এক মৃতদেহ পড়ে ছিল—গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল, হয়তো স্যালাইন নেওয়ার সময়ই মৃত্যু হয়।

আমার অনেক পরিচিত সেখানে এসেছিলেন—অফিসের সহকর্মীরা, গ্রামের এক ভাইয়ের মেয়েও এসেছিলেন। রাত ৮টার দিকে হাসপাতালের লোকজন জানায়, উন্নত চিকিৎসার জন্য আমাকে বড় হাসপাতালে যেতে হবে। সেদিন রাতে তারা শুধু ব্যথানাশক দিয়েই পাঠিয়ে দেন।

আমি সেই রাতে আমার সহকর্মী নাহিদের বাসায় রাত কাটাই। পরদিন, ৬ আগস্ট, আমাকে টাঙ্গাইলের কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারা সাময়িক চিকিৎসা দেয়। তবে পরদিন বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য আমাকে ঢাকা মেডিকেলে যেতে হবে।

07 august 2024 kumidini hostpital to dhaka hospital

তবে আমি ঢাকা মেডিকেল না গিয়ে আমার স্ত্রীর মামাতো বোনের সহায়তায় কুর্মিটোলা সরকারি হাসপাতালে যাই। তিনি কয়েকজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেন। আমার অবস্থা দেখে কেউ গুলিগুলো অপারেশন করে বের করতে রাজি হননি। তারা বলেন, “গুলি সীসা, শরীরে শুকিয়ে যাবে। মাঝে মাঝে ব্যথা বা জ্বর হতে পারে। যদি শরীর মেনে নেয়, সমস্যা হবে না। আর যদি বের করতেই হয়, তাহলে পিঠের কাছ থেকে এক ইঞ্চি মাংসসহ কেটে বের করতে হবে।”

একজন ডাক্তার ওষুধ লিখে দেন। আমার স্ত্রীর মামাতো বোন ওষুধগুলো এনে দেন হাসপাতাল থেকেই। এরপর আমি আমার গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাই।


✍️ লেখক: একজন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বেঁচে ফেরা নাগরিক
📅 সময়কাল: আগস্ট ২০২৪
🌐 ব্লগ: AnwarulDiary

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন
comment url